একটা বিষয় অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছে। কিন্তু কাছের অনেকেই আবার না ভেবে বসেন তাদেরকে টার্গেট করে লিখছি, তাই এতদিন লিখা হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটা ইদানিং আবার নতুন করে মাথার ভিতর এমন ঘুর ঘুর করছে, জিজ্ঞেস না করে পারছিনা।
.
পরিচিত অপরিচিত প্রায় সব মেয়েদেরকেই (কিছু এক্সেপশনাল ছাড়া) দেখি ছবি তোলার সময় ঠোঁট দু'টোকে চুক্কা করে, মানে কেমন যেন দুই ঠোঁটকে একসাথে লাগিয়ে অনেকটা চুম্মা দেয়ার ভংগিতে ছবি তুলেন। একজন আমাকে জানালেন এটাকে বলে 'ডাক-ফেইস'/ হাঁসের চেহারা। কথাটা কতটুকু ঠিক জানিনা।
.
কিন্তু যা জানতে চাই তা হলো, এই পোজটার সিম্বলিক মিনিং কী?
.
আমরা যাই-ই করি না কেনো, আপনি জেনে করেন বা না জেনে করেন, সবকিছুরই একটা মিনিং আছে। যেমন কপালে টিপ দেয়াটা।
.
কোনো ধরনের রিলিজিয়াস/ধর্মীয় তর্কে না গিয়ে হিস্টরিক্যাল পার্স্পেক্টিভ থেকে, কপালে টিপ দেয়াটা হয়তো আপনার কাছে খুব কালচারাল একটা সৌন্দর্য্য, কিন্তু ইতিহাস বলে এর মিনিং দুইটার যে কোনো একটা।
.
(স্যরি রেফারেন্স এনে দিতে পারবোনা, অতীতের পড়ালেখার স্মৃতি থেকে বলছি। রেফারেন্স দিতে হলে অনেক সময় ঘেটে আবার পড়ালেখা করে বের করতে হবে)।
.
খুব সম্ভব প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সময়েই, কিছু মেয়ের জন্য (যারা শরীর দিয়ে মানুষকে এন্টারটেইন করতো) কপালে টিপ দেয়াটা ছিলো বাধ্যতামূলক। যেন তাদেরকে চেনা যায়।
.
আবার হিন্দু সংস্কৃতিতে অনেক অনেক প্রাচীন কাল থেকেই বিবাহিত মেয়েরা কপালে টিপ দিতে বাধ্য ছিলো। এটা তাদের বিবাহিত হওয়ার সিম্বলিক স্ট্যাম্প এর মত।
.
ইতিহাসের এই দুইটার একটাও আমার কাছে খুব সম্মানিত কিছু মনে হয়নি। বরং দু'টো কারনই খুবই নীচু ধরনের মানসিকতার প্রকাশ।
.
যে শরীর বিক্রি করে (শরীর বিক্রি ইটসেলফ নিয়ে সব ধরনের তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে বলছি), তাকে কেনো তার পেশার জন্য এভাবে কপালে সীল মেরে ঘুরতে হবে, অথবা যে মেয়ে বিবাহিত তাকেই বা কেনো তার বিয়ে হয়ে গেছে এটা এভাবে চব্বিশ ঘন্টা কপালে ঘোষনা দিয়ে বেড়াতে হবে, কেনো তার জামাইও কপালে টিপ লাগিয়ে ঘুরবেনা- এগুলো আমার চিন্তা।
.
তাই কপালের টিপ এখন আপনার কাছে যতই কালচারাল হোক না কেনো, আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে চরম অপছন্দীয় একটা কাজ।
.
আপনি যাই-ই করেন না কেনো, তা টিপ পড়েন বা ডাক ফেইস বানিয়ে ছবি তুলেন, প্লীজ এর মিনিং জেনে নিয়ে তারপর যদি আপনার ইচ্ছে হয় তারপর করবেন। কেউ একটা কিছু শুরু করলো, ব্যাস, আপনিও স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন, তাহলে আপনার নিজস্ব স্বতন্ত্রবোধ/ পার্সোনালিটির কী দাম থাকলো?
.
ডাক-ফেইস মূলতঃ শুরু হয়েছিলো Myspace এ। ওয়েষ্টার্ন সমাজে মেয়েদের যে কঠিন রকমের physical appearance based সংস্কৃতি, এটাকে ভেংগাতে বা যাকে বলে mimick করা তা করতে গিয়ে প্রথম দিকে প্রচুর মেয়ে এটা করা শুরু করে। কারন ট্র্যাডিশনালি সাধারনত যেসব মেয়ের ঠোঁট একটু পাতলা- কিন্তু বড় আর একটু গোল টাইপ (হাঁসের মত), আর cheekbones কে বাংলায় কী বলে তাওতো ভুলে গেলাম (!), cheekbones টা একটু বড় (হাঁসের মত ঠোঁট করলে cheekbones অটোমেটিক একটু বড় দেখায়), এ ধরনের চেহারাকে মনে করা হয় সেক্সি/ sassy!
.
এজন্যেই দেখবেন হলিউডের এঞ্জেলিনা জোলি থেকে শুরু করে বলিউডের ঐ নতুন নায়িকাটার নাম কী যেন, ঐ যে, ওহ মনে পড়েছে, আনুশকা শার্মা এরা সবাই নিজেদের ঠোঁটের সার্জারী করে ঠোঁটকে পাতলা করে একটু সাইডে খাঁজ কাটা (হাঁসের মত) করে নিয়েছে, ডাক-ফেইসের আদলে, নিজেদেরকে সেক্সি/ sassy/ saucy দেখানোর জন্য।
.
যারা মেয়েদের ফিজিক্যাল সৌন্দর্য্য নিয়ে পড়ালেখা করেন, তারা আরো ভালকরে বুঝিয়ে বলতে পারবেন আসলে আমি কী বলতে চাচ্ছি।
.
তবে এই মিনিংটা বুঝাতে চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি তা খুব সহজ বাংলায় বললে একটু রুড শোনাতে পারে।
.
আপনি যদি নায়িকা বা মডেল হন, তাহলে সেক্সি পোজ দিলে আমি কিছু বলবো না। কারন শরীরই আপনার পুঁজি। এই শরীর বিক্রি করেই আপনি মুভি করেন বা মিডিয়ায় কাজ করেন। আপনার শরীর যত lucrative হবে, সোজা বাংলায় যত বেশী দর্শকের মনে হবে আপনি একটা "মাল", তত আপনার ব্যবসা সফল!
.
কিন্তু আপনি যদি নায়িকা বা মডেল না হোন, তাহলে কেনো আপনি নিজেকে "সেক্সি" দেখাতে চাইবেন??? সিরিয়াসলি!
.
আপনি কি সবার সাথে সেক্স করতে চাচ্ছেন? আ'ম এক্সট্রিমলি স্যরি এভাবে জিজ্ঞেস করার জন্য, কিন্তু আপনি নিজেকে সেক্সি দেখাতে চাইছেন, এর সোজা মিনিং হলো যে ছেলেরা (বা মেয়েরা) আপনার এই ছবি দেখবে তারা যেন ভাবে বলে ইশ আপনি কত সেক্সি! এর অর্থ, আপনার সাথে সেক্স করার ইচ্ছে হবে!
.
সেক্সি অর্থ তো এটাই নাকি? সেক্সি, যাকে দেখলেই মনে হবে এর সাথে বিছানায় যাই!
.
কথাগুলো খুব বিশ্রী হয়ে গেলো, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, কিন্তু সিরিয়াসলি, ডাক-ফেইসের অন্য কোনো ইন্টারপ্রিটেশান করতে পারলে প্লীজ আমাকে জানাবেন। নিজেকে সেক্সি দেখানোর চেষ্টার অর্থ কী তাও।
.
নিজেকে সুন্দর দেখাতে চান, তা নিয়ে আমার টোটালি কোনো অবজেকশান নেই। কিন্তু সেক্সি দেখাতে চান? এর মানে কী?
.
একবার এক গ্রুপের সাথে চেরী-বাগানে বেড়াতে গিয়ে দেখি ঐ গ্রুপের ভাবী-আপুরা সব দলবেঁধে একটা পার্টিকুলার পোজ দিয়ে ছবি তুলছেন। পোজটা হলো গাছ থেকে ফ্রেশ চেরী ছিঁড়ে চেরীটা ঠিক ঠোঁটের সামনে ধরে লোভনীয় ভংগীতে খেতে যাচ্ছেন যাচ্ছেন টাইপ পোজ!
.
নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে গ্রুপ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম এত বিশ্রী মিনিংফুল পোজ দিয়ে সবাই ছবি তুলছে দেখে।
.
একটু পর ফিরে এসে দেখি, হায় হায়! পোজ আরো গভীর মিনিংফুল হয়েছে এখন। প্রত্যেকটা হাজবেন্ড-ওয়াইফ, হাজবেন্ড চেরী নিয়ে ওয়াইফের ঠোঁটের সামনে ধরছে আর ওয়াইফ চেরীটা খাওয়ার চেষ্টা করার ভান করে পোজ দিচ্ছে!
.
আমি স্রেফ স্তব্ধ হয়ে ভাবছিলাম, এরা কী জেনে বুঝে এই পোজ দিচ্ছেন, নাকি গাধার মত কোথাও এমন পোজে ছবি তুলতে দেখেছেন, ব্যাস, নিজেরাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন!
.
বিভিন্ন মুভিতে, লিটারেচারে চেরীকে খুব স্পষ্ট করেই দেখানো হয় সেক্স'র সিম্বলিক রুপ হিসেবে। এজন্যেই দেখবেন আগের কালের বাংলা মুভিতে যেমন নায়ক নায়িকার একসাথে রাত কাটানোর সিম্বলিক প্রেজেন্টেশান হিসেবে দৃশ্যে দেখানো হতো সকালে নায়কের পাশের বালিশে নায়িকার চুলের কাঁটা বা ক্লিপ, তেমন মেয়েদের সেক্সি হওয়ার সিম্বলিক প্রেজেন্টেশান হিসেবে ওয়েষ্টে- বিশেষ করে প্রচুর আইটেম ম্যাগাজিনের কভার ফটোতে- দেখায় কোনো মেয়ে কড়া লাল লিপিষ্টিক দেয়া দুই ঠোঁট একটু হাঁ করা যাতে জিহবাটা অল্প দেখা যাচ্ছে এবং ঠিক দুই ঠোঁটের সামনে লাল টকটকে এবং চকচকে চেরী ধরা!
.
আপনি কেনো ঐসব সস্তা আইটেম ম্যাগাজিনের কভার ফটোর মেয়েগুলোর মত সেক্স কে রিপ্রেজেন্ট করে পোজ দিবেন? বা স্রেফ নিজেই ভাবুন, এসব পোজ আপনার কোন ধরনের মানসিকতার রিফ্লেকশান? আপনি মানসিকভাবে সুস্থ আছেন তো?
.
এ সব ধরনের পোজ মূলতঃ আপনার মধ্যকার দু'টোর যে কোনো একটা দিককে হাইলাইট করে।
.
একঃ হয় আপনি আপনার সৌন্দর্য্য নিয়ে inferiority complex এ ভুগছেন। নিজের ঠোঁট আল্লাহ যেভাবে বানিয়ে দিয়েছেন সেভাবে আপনার পছন্দ না। তাই হাঁসের মত ঠোঁট চাচ্ছেন। যেন আপনাকে আরো "সেক্সি" দেখায়।
.
অথবা,
.
দুইঃ আপনি peer pressure এ নিজের পার্সোনালিটিকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। আপনার ফ্রেন্ডসরা বা যাদের সাথে আপনার চলা-ফেরা, উঠা-বসা, ঘুরা-ঘুরি, তারা যেহেতু ডাক-ফেইস করে ছবি তুলছে, আপনি না তুললে কেমন দেখায়?
.
দু'টোর একটাও সুস্থ মানসিকতা না। আপনি যেমন, আপনি তেমনই সুন্দর। আপনাকে নকল করে পোজ দিয়ে সুন্দর সাজতে হবে না। আপনার আশেপাশের মানুষের যদি আপনার ন্যাচরাল সৌন্দর্য্য দেখার মত চোখ না থাকে, তা আপনার আশেপাশের মানুষের ব্যর্থতা। আপনার না।
.
আপনার খুব ছোট ছোট কাজ/ কথা/ চাল-চলন আপনার ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে ডাক-ফেইসের কালচারে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেকে ছোট করার, নিজের ব্যক্তিত্ব/পার্সোনালিটিকে এমন নীচুভাবে প্রকাশ করার কোনো মানে আছে, বলুন?
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
.
লেখাঃ ফারজানা মাহবুবা (আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)