আমাদের গ্রামের মাঠের মধ্যখানে অনেক বড় ঈদগাহ। ঈদগাহের নাম ওমরসিং ঈদগাহ যদিও আমরা ময়মনসিং ঈদগাহ বলেই ডাকতাম। আশেপাশের পাঁচ গ্রামের মানুষ এ ঈদগাহে নামাজ পড়েন। ঈদগাহের চারিদিকে জাম আর খেজুর গাছে ঘেরা। আর মাঝখানে থেকে পুরো ঈদগাহকে ছাতার মতো বেষ্টন করে রাখত বিশাল এক কড়ই গাছ। দাদার মুখে শুনতাম তার দাদারা তৈরী করে গেছেন এই ঈদগাহ। আমাদের ঈদের পুরোটাই যেন এই ঈদগাহ ঘিরে। কখনও বা হাটু পানি ভেঙে যেতে হত সেখানে। আর নামাজের সময় জোকের কামড় ছিল বাড়তি পাওনা। এমনও হয়েছে বাড়ি এসে দেখি সাদ পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে গেছে। জোক বাবাজি কখন নিজের কার্য সম্পাদন করে নিজেই চম্পট দিয়েছে টের পেতাম না।
আমাদের ঈদ শুরু হতো ঈদের আগের দিন সন্ধা থেকে। রোজার ঈদে আকাশ মেঘলা থাকলে চাঁদ দেখা নিয়ে মাঝেমধ্যে সমস্যা হতো। শিশু মনে প্রবল একটা ধারণা ছিল নিজে চাঁদ না দেখলে ঈদ হবেনা। হবে শুনলেও মনে সন্দেহ থেকে যেত, কারণ চাঁদ তো দেখতে পারিনি। ইফতার করার পড়েই মসজিদের পাশের বিশাল মাঠটাতে যেতাম চাঁদ দেখতে। আমরা চাঁদ দেখার জন্য যেমন চঞ্চল ছিলাম বাড়িতে মা বোনেরাও থাকত উৎকন্ঠায়। আমরা যখন গিয়ে বলব চাঁদ দেখেছি তখন যেন তাদেরো ঈদ শুরু হবে। কে আগে চাঁদ দেখতে পায় এ নিয়ে চলত নীরব স্নায়ুযুদ্ধ।
চাঁদ দেখতে পাওয়ার পর সমস্মরে গেয়ে উঠতাম "ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ" এর পর শুরু হত পটকা, বাজি ফোটানোর ধুম। অপেক্ষাকৃত সাহসী ছেলেদের জন্য ছিল আগুনের ফুল্কি উড়ানো। এ যেন আগুনের বল কে কত উপড়ে ছুড়তে পারে তার পরীক্ষা নয়, এ যেন বংশ গৌরব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
ভোর থেকেই আব্বা ডাকাডাকি শুরু করতেন গোসল করে তৈরি হওয়ার জন্য। আমি দেখতাম আমার পিঠাপিঠি ভাইটি উঠেছে কি না। ও না উঠলে আমিও উঠতাম না। তবুও আব্বা ঈদের দিন ফজরের নামাজ মিস দেওয়াতে কোনভাবেই রাজি নন। অগত্যা গোসল করে ফজরের নামাজ পড়তাম। এরপর পায়জামা,আর পাঞ্জাবি, খুশবু, সুরমা—এসবের পর মা সেমাই নিয়ে এসে হাজির হতেন। ছোট ভাই মুখ গোমড়া করে রাখত। কারণ মিষ্টি একদম পছন্দ করত না। মা বলতেন, এটা না খেয়ে ঈদগাহে গেলে ঈদ হবে না। ঈদ হবে না, বলে কী! এত অপেক্ষার ঈদ না হলে উপায় আছে? অগত্যা চোখমুখ কালো করে কয়েক চামচ খেয়ে নিত। আমি ব্যাপারটা উপভোগ করতাম। এমনিতেই মিষ্টি খুব প্রিয় ছিল আর ভাই কোন কিছুতে হেনস্থা হলে সেটা ছিল যুদ্ধ জয়ের সমান। সম্মুখ সমরে না পারার কষ্ট থেকেই হয়ত এমন অনূভুতি। যাকে বলে 'দূধের স্বাধ ঘোলে মেটানো।
ঈদগাহে যেতাম বাড়ির সবাই দল বেঁধে। যাওয়ার আগে দাদি মা চাচি ফুফু দের বলে যাওয়া ছিল অলিখিত রীতি। এরপর বড়রা আমাদের ছেড়ে মাঠে গিয়ে বসতেন। আমরা ছোটরা বেলুন কিনে ফুলিয়ে মাঠের চারদিকে ঘুরতাম। মাঝেমধ্যে বেলুন ফুটে ঠাস করে শব্দ হতো। মাঠের একপাশে বিক্রি হতো চানাচুর, চকলেট, পিয়াজু, চালতার আচার, আইস্ক্রীম মাঝেমধ্যে আইস্ক্রীম ও চালতার আচার খেতাম। এসব করতে করতে সময় কেটে যেত। নামাজ শেষে বড়রা আমাদের খুঁজে বের করে নিয়ে যেতেন। আব্বা ও চাচা আমাদের হাতে টাকা দিতেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দরিদ্রদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
আমরা ওঁদের টাকা দিয়ে খুব আনন্দ পেতাম। আসার সময় মায়ের জন্য আচার কিনে নিয়ে আসতাম। বাবা, চাচা, ফুফা, ফুফু, মা, চাচি, ফুফাত ভাইরা সালামি দিত এর বাইরে পাড়াত কোন চাচা দাদা বা ভাইয়ের সুনজর ও পড়ত আমাদের প্রতি। তবে এক্টু মনঃকষ্ট মনে হয় রয়েই যেত যদি ভাইটা না থাকত সব আমার হত। এটা ছিল শৈশবের ঈদ।
শৈশবের সেই সব স্মৃতির কারণেই ঈদ এত দামি, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা উৎসব। দেশের যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেন, বছর ঘুরে ঈদ এলে গ্রামে সেই ঈদগাহে নামাজ পড়তে হবেই। নয়তো ঈদকে ঈদ বলে মনে হবে না।
আমাদের ঈদগাহে এখন সেই গাছগুলো আর নেই। মেঝে তে ঘাসের পরিবর্তে এখন বিদেশী টাইলস শোভা পায়। হয়তবা কোন জোক আর কারো সাদা পাঞ্জাবী লাল করে দেয়না। সেই গাছগুলি নেই, চাঁদ দেখার সেই ফাকা মাঠটাতে আজ দ্বীতল পাকা বাড়ি,হয়ত এখনো কেউ পটকা ফুটায় কিন্তু পৌরুষের প্রতীক বহন করা সেই আগুনের বল উড়ানো এ প্রজন্মের কেউ দেখেনি আমি নিশ্চিত। মা, চাচীরাও আর চাঁদের খবরের জন্য কিশোর ছেলেগুলার মুখ চেয়ে থাকেনা। হাতের কাছেই একটা বোকা বাক্স আছে না! দাদা চলে গেছেন না ফেরার দেশে, আব্বার চুলে পাক ধরেছে,চাচারাও আজ সাথে নেই, সেই ঈদ ও আর নেই।-sad-