
অসাধারণ প্রশ্ন। উত্তরটা একটু লম্বা হতে পারে।
গ্রীষ্মজয়ের ব্যাপারটা শুরু হতো বাড়িঘরের নির্মাণ আর স্থাপত্য থেকে। তাতে কী কী থাকত?
মোটা দেয়াল ও ছাদ।
তাতে বাইরের গরম বাইরেই থেকে যেতো। রোদে উত্তপ্ত দেয়ালের গরম ঘরে ঢুকতে পারতো না।
মাটির দেয়াল।
গ্রামের দিকে ব্যাপারটা ভারী কার্যকরী। পোড়া ইটের থেকে কাঁচা মাটির উত্তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি।
মাটির মেঝে।
একই ব্যাপার। গোবর লেপে দিলে তার ঠান্ডা থাকার ক্ষমতা আরো বেড়ে যায়।
ছনের ছাদ।
এরও উত্তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক। ইঁট-সিমেন্টের ছাদের চাইতে অনেক বেশি।
ছোট জানালা।
একই কাজ করতো। গরম বাতাস ঘরে ঢুকতো কম।
বেশ উঁচুতে জানালার অবস্থান এবং ঘুলঘুলি। দুটোই বাতাস চলাচলের কাজ করতো। গরম বাতাস যেহেতু ওপরে উঠে যায় তাই এগুলো গরম বাতাস বার করে দিত, ঠাণ্ডা বাতাস নয়।
কাঠের জানালা।
আজকালকার কাচের জানালা গরম ঠেকায় না। বরং তারা নিজেরাই উত্তাপ শোষণ ও বিকিরণ করে ঘর আরো গরম করে ফেলে। বেশিরভাগ মানুষ রোদের সময়ে জানালা আটকে রাখতো। রোদ কমে গেলে জানালা খুলে ঘরের গরম বার করে দিতো।
মোটা পর্দা।
অনেক সময়ে দু’স্তরের পর্দা। বাতাস ঢুকবে, কিন্তু রোদ নয়।
দক্ষিণমুখী জানালা।
দখিনা বাতাস ঘর ঠাণ্ডা রাখায় অনন্য।
উঁচু সিলিং।
একে তো গরম বাতাস ওপরে উঠে যায় তার ওপর ঘরের ভেতরে তৈরি হওয়া উত্তাপও তাতে ছড়িয়ে যাবার সুযোগ পায়।
জানালায় চওড়া কার্নিশ।
তাতে কেবল বৃষ্টি নয়, রোদও প্রতিরোধ হয়।
ভেতরমুখী ঘর।
আগের বনেদী বাড়ি কিংবা গ্রামের বাড়ি দেখেছেন? কেন্দ্রীয় উঠানের চারপাশ ঘিরে তৈরি হত বাড়ি। তাতে বাইরের গরম নয়, ভেতরের ঠাণ্ডার দিকে থাকতো বাড়ির মুখ।
ঘরের ভেতর জল।
সে জল যে কোনো মুখ খোলা পাত্রেই রাখা যায়। গরমে জল উদ্বায়ী হয়ে ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা করে। নবাবী যুগে অনেক বাড়িতে ঘরের ভেতর জলের নালা থাকতো। কোম্পানি যুগে চৌবাচ্চা।
বাড়ির সাথে গাছ। গাছের ছায়ায় ঘর ঠাণ্ডা থাকে।
##এর সাথে যোগ হতো জীবন যাপন। কিরকম জীবন যাপন?##
হাল্কা পোষাক।
সিন্থেটিক কাপড় (পলিস্টার, জর্জেট, টেরিকটন) নয়, মোটা কাপড় (জিন্স) নয়, শ্বাসরোধী কাপড় (সিল্ক) নয়। মানুষের পোষাক ছিলো সুতী। পাতলা সুতী। তাও বেশিরভাগ সময়ে সাদা রঙের। রঙিন কাপড় দ্রুত গরম হয়ে ওঠে।
প্রচুর অন্তর্বাস নয়।
এক কালে বাংলার নারী-পুরুষ খালি গায়ে থাকতো। তাতে ঠাণ্ডা থাকার সুবিধে অনেক। আজকালকার মতো আন্ডরওয়ার-ব্রা-শেমিজ-বেনিয়ান নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি ছিলো না।
জুতো নয়, চটি।
পা ঠাণ্ডা রাখা খুবই প্রয়োজন। শরীর সীমানাগুলো (হাত, পা, মাথা) দেহকাণ্ডের থেকে দ্রুত গরম হয়ে যায়।
টুপি নয়, খালি মাথা।
মাথা ঠাণ্ডা রাখাও প্রয়োজন। চুল লম্বা থাকলে বেঁধে রাখাও প্রয়োজন।
পাখা।
গ্রামে গ্রামে কত রকম পাখা যে ছিলো! তাছাড়াও টানা পাখার চল ছিলো জমিদারি যাবার পরেও বেশ অনেকদিন। ততদিনে সিলিং ফ্যানও চলে এসেছে। প্রথমে পেট্রল পাখা, তারপর বৈদ্যুতিক পাখা।
ঘর মোছা বা লেপা।
ঘন ঘন ঘর মুছলে বা লেপে দিলে ঘর ঠাণ্ডা থাকে। এতে ব্যবহার করা জল ঘরের গরম শুষে নিয়ে উদ্বায়ী হয়ে ঘর ঠাণ্ডা করত।
জানালার পর্দায় জলের ছিটে।
তাতে গরম বাতাস ঘরে ঢোকার সময়ে অনেকটাই ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে। রোদও অনেকটা ঠেকে যায়।
ঘরের ভেতর জল।
যাদের স্থাপত্যে জলের ব্যবহার ছিল না তারা জীবন যাপনের অংশ হিসেবে ঘরে জল রাখত। অনেকে বরফও রাখত।
শান্ত খাবার।
মাংস ও মসলাদার খাবার শরীর গরম করে ফেলে। নিরামিষ ও ভাত শরীর ঠাণ্ডা রাখে। বিশেষ করে পান্তা ভাত।
টক খাবার।
টক খাবার শরীর ঠাণ্ডা করে।
দই। দই শরীর ঠাণ্ডা করে।
প্রচুর স্নান।
সাথে হাত-মুখ-পা ধোয়া। বাংলার মানুষ পৃথিবীর যে কোনো দেশের মানুষের চাইতে স্নান বেশি করে। একালেও।
প্রচুর জলপান।
মদ্য পান থেকে বিরত থাকা। মদের কারনে শরীরে জল কমে যায়। যদি মদ খেতেই হয় তবে মদের সাথে প্রচুর জলপান করা প্রয়োজন।
আমার বাড়িতে একটি ঘরে একটি ছোট্ট এসি আছে। বাকিটা আমরা জীবন যাপন দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করি।
শেষ কথা: জল।
গ্রীষ্মের প্রধান শত্রু জল।
সেটা আগেকার মানুষরা খুব ভালোভাবে জানতেন। সবশেষে ভুলে যাবেন না ৫০ বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রাই কম ছিলো।