৩. "স্যার আমার বাবায় বাঁচবে তো!" রোগীর মেয়ে নামাজ পড়ে আসছে মাত্র জীবনের সবটুকু আঁকুতি দিয়ে মিনতি করে আসছে। আমার কাছে সবথেকে কঠিন প্রশ্ন মনে হয় এটা, হায়াত - মউত আল্লাহর হাতে আমাদের চেষ্টা ছাড়া করার কিছু নাই। মৃত্যু পথযাত্রী বাবার মেয়েকে আমার কি বলা উচিত! এই সিচুয়েশনে কখনো মিথ্যে সান্ত্বনা দেই না। দেওয়া উচিত ও না। বললাম যদি টাইম মতন আই সি ইউ তে নিতে পারেন তাহলে ২০ ভাগ সম্ভাবনা আছে বাঁচার। তবে আল্লাহর হাতে সব আল্লাহ চাইলে অনেক অসম্ভব ও সম্ভব হয়ে যায়। আর অন্যদিকে বাংলাদেশের এম্বুলেন্স! ৪ টা ৩০ বেজে গেছে তখনো তার খোজ নাই। প্যাশেন্টের স্যাচুরেশন ফল করা শুরু করছে আবার এজ প্রেডিক্টেড। বুকের ভিতর জমে থাকা কফ গলায় চলে আসছে, সাকশন দিয়ে বের করতে হবে। জিহাদ কে ডাক দিলাম যা সাকশন মেশিন নিয়ে আয়। এরপরের উত্তর ছিল "স্যার ওটিত্তন কোন কিছু বাইর করন যাইবো না উফরের স্যার গো নিষেধ আছে " আমি অনেক ধৈর্য্যশীল এবং ঠান্ডা মাথার মানুষ, কিন্তু এই সিচুয়েশনে আর ধৈর্য্য রাখতে পারলাম না, বললাম তোর উপরের স্যারের গুষ্টি কিলাই বান্দর এখন ই নিয়ে আয় যা। জিহাদ গেল মেশিন আনতে, এইটা আনতে আরো ১৫ মিনিট লাগবে আমি জানি, এম্বুলেন্সে ফোন দিতে বললাম তারা জানালো তাদের আরো ২০ মিনিট লাগবে! বুঝতে পারলাম না কত মিনিট গেলে তাদের ২০ মিনিট হবে। যে সকল প্যাশেন্ট শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে তাদের কে প্রপড আপ ( ৪৫ ডিগ্রী এংগেলে শুইয়ে) পজিশনে রাখতে হয়। এর জন্য হাসপাতালে বিশেষ ধরনের বেড থাকে। আমাদের এখানেও ছিল কিন্তু দেই বেড এর স্প্রিং আজকেই নষ্ট হয়ে গেছে তাই আর বেড উঠে না! এতক্ষণ প্যাশেন্ট তার মেয়ের উপর ভর দিয়ে ছিল, কিন্তু পজিশন হচ্ছে না দেখে আমি নিজেই প্যাশেন্ট কে আমার হেলান দিয়ে রাখলাম। আর স্যাচুরেশন দেখছি ৭৫-৮০ এর ঘরে উঠা নামা করে। বুঝতে পারলাম আরো কমবে, এই দুনিয়ার যত দর্প অহংকার সব ই যে আল্লাহর কাছে তুচ্ছ তা যারা ডাক্তার বা হাসপাতালে কাজ করেন তারা বুঝেন। জিহাদ সাকশন নিয়ে আসল কিন্তু সাকশন টিউব আনে নাই। ইচ্ছামতন গালি দিয়ে ওরে আবার আনতে পাঠাইলাম। ওটি টেবিলে স্যার রা সামান্য ভুল করলেও গালি কেন দিতেন এখন বুঝতেছি। একটা প্যাশেন্টের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়, কোনভাবেই সময় নষ্ট করা যাবে না। স্যাচুরেশন কমতেছে, প্যাশেন্টের মেয়ে দুইজনের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না আর্তনাদে পরিণত হচ্ছে, আমি অথর্বের মতন বসে আছি, আমার হাতে দেয়া সকল ট্রীটমেন্ট শেষ। মনে মনে দোয়া পড়তেছি আল্লাহ এবারের মতন বাঁচাইয়া দাও প্যাশেন্ট কে। নিজের ই বুকটা ভারী ভারী লাগছে, এতক্ষণ কান্না চাপাইয়া রাখার কারনে হয়ত বা৷ এম্বুলেন্স আসার আওয়াজে সব নিরবতা যেন ক্ষুন্ন হয়ে গেল! এতক্ষণ বোধহয় অন্য কোন ঘোরে ছিলাম। প্যাশেন্টের স্যাচুরেশন তখন ৬৫%। ঘড়ির দিকে তাকালাম ৫ টা ১০। পুরো ১ ঘন্টা ১০ মিনিটে এসে এম্বুলেন্স পৌছল। রোগী কে এম্বুলেন্স এ উঠিয়ে দিলাম , বারবার ভাবছিলাম এদের কেউ একজনের নম্বর রেখে দিব পরবর্তী খোজ নেয়ার জন্য , কিন্তু তাড়াহুড়ায় ভুলে গেলাম। যেন এক যুদ্ধ শেষ হলো । কিন্তু তাতে সফল কিনা জানি না।
পুনশচঃ ডিউটি শেষ করে ফেরার পথে বাসের জন্য ওয়েট করছিলাম । সকাল ৯ টা বাজে তখন । ঠিক তখন বিছানার চাদর , টিফিন কারি হাতে একজন কে দেখলাম রাস্তার অন্যপ্রান্তে । দেখেই চিনলাম গতরাতে রোগীর পাশে থাকা তার এক মেয়ে। বুঝলাম আমার যুদ্ধ শেষ হলেও অন্য প্রান্তে অন্য ডাক্তারের যুদ্ধ শুরু হয়েছে ।
শুভ জন্মদিন মিঃ রাইট ১৩/১১/২০২২
Posted By: mr_right
Post ID: 6995
Posted on: 2 months 6 days ago
Authorized by: Mostakim